মঞ্জীরার দিন শুরু হয়ে গেল। এখন হালকা জগিং, তার পর আধঘণ্টা জিম। সে পর্ব মিটলে কোনও
মতে রেডি হয়ে অফিসের জোয়াল টানতে যাওয়া।
এমনটাই চলছে গত বেশ কয়েক বছর ধরে।
পাঁচ বছরের ডাম্বোর হাত ধরে যে দিন শ্বশুরবাড়ির পাট পাকাপাকি ভাবে তুলে দিয়ে মায়ের এই ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিল, সে দিনও কি ভেবেছিল, বাকি জীবনটা এই জায়গাতেই কাটাতে হবে তাকে?
সবটুকু দায় ঝেড়ে ফেলে চলে এলেও কি কিছুই বাকি থেকে যায় না? অথচ এমন এক দিনও কাটে না, যে দিন সেই নিরাপত্তার ঘেরাটোপে কাটানো ছ’টা বছরের কথা মনে পড়ে না তার।
আকাশদীপও কি ভাবে তার কথা? সম্ভবত না। উচ্চাকাঙ্ক্ষার যে রথে সে বিশ্ব পাড়ি দিচ্ছে, যে তুমুল ব্যস্ততায় একের পর এক শৃঙ্গ জয় করে চলেছে সে, তাতে পিছন ফিরে তাকানোর সময় কোথায় তার?
অথচ যুগ পাল্টেছে, মঞ্জীরার পরিচিত কত মেয়েই তো স্বামীর ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মতো জীবন কাটাচ্ছে। মনপসন্দ চাকরি, সন্তানপালন, মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, জোরালো পুরুষসঙ্গী... কী নেই তাদের? এ সব তো মঞ্জীরারও আছে, তবু সব কিছু ছেড়ে কেন সে বেরিয়ে আসতে পারে না?
কেন আলমারির লকারে রাখা, আকাশদীপের পাঠানো ডিভোর্স পিটিশনে সই করে উঠতে পারল না আজও? সে কি এখনও অপেক্ষা করে আকাশদীপের ফিরে আসার?
হালকা কিছু স্ট্রেচিং সেরে ট্রেডমিলে উঠেছে মঞ্জীরা। ধীরে ধীরে বোতাম চেপে গতিবেগ বাড়াচ্ছে। পায়ের নীচে সরে সরে যাচ্ছে কনভেয়ার বেল্টের কৃত্রিম জমি। তালে তালে ক্রমশ গতি বাড়াচ্ছে মঞ্জীরাও।
তাদের আবাসনের জিমটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আজ এসির তাপমাত্রা বেশ কম করে দেওয়া আছে। তবুও ঘামছে মঞ্জীরা। হৃৎপিণ্ডের প্রচণ্ড লাব-ডুব শুনতে পাচ্ছে সে, রক্তকণারা তীব্র বেগে বইছে শিরা ধমনীর অলিগলিতে। তবু থামছে না মঞ্জীরা। কে যেন থামতে দিচ্ছে না তাকে।
ঠিক এমনটাই মনে হত তার বহু বছর আগে। স্প্রিন্টার হিসেবে ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে একটা পদকও জিতেছিল ছোট্ট মঞ্জীরা।
তবে সে দৌড় বেশি দূর এগোয়নি।
কেন যে অকালে থেমে গেল মঞ্জীরা! বাবা চায়নি সে পড়াশোনা ফেলে রোদে রোদে দৌড়ে বেড়াক, তার মনে আছে বাবা প্রায়ই বলত, “গায়ের রং পুড়িয়ে ছুটোছুটি করলে আখেরে লাভ কিছু হবে না। এই পোড়া দেশে ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনও খেলার কদর আছে না কি! মিছিমিছি বিয়ের বাজারে নিজের দাম কমানো...”
আজ ভাবলে অবাক হয় মঞ্জীরা। আজকাল ছেলেমেয়েরা কত সচেতন! নিজের চাওয়া পাওয়া কী সুন্দর বুঝে নিতে পারে। বাকিদের কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল, ওই যে অতটুকু ডাম্বো, সেও এখন থেকেই নিজের ক্রিকেট কেরিয়ার নিয়ে কী সাংঘাতিক পার্টিকুলার।
না, বাবার মর্জি নয়, স্পোর্টস-এ কেরিয়ার হয়নি তার, কারণ তার নিজেরই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না।
অবশ্য কিসেই বা আকাঙ্ক্ষা ছিল তার? জীবনে কোন কাজটাই বা মন দিয়ে করেছে মঞ্জীরা?
গ্র্যাজুয়েশনের রেজ়াল্ট বেরোনোর আগেই মস্ত বনেদি পরিবারে সম্বন্ধ করে বাবা তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিল, মুখ ফুটে না বলতে পেরেছিল মঞ্জীরা?
বছর ঘুরতে না ঘুরতে তার মেজাজ-মর্জির তোয়াক্কা না করেই অবাঞ্ছিত গর্ভাধান। ক্যালেন্ডারের পাতা ভাল করে পাল্টে ওঠার আগেই সে দিনের কলেজ-পড়ুয়া, ছটফটে মেয়েটা হঠাৎ একটা গাবদু-গুবদু বাচ্চার মা হয়ে গেল।
জীবনে কোন ঘটনাটাই বা হয়েছিল মঞ্জীরার মর্জিমাফিক?
এই সময়টায় পা, কোমর যেন ভেঙে পড়তে চায় মঞ্জীরার, তবু দৌড় থামায় না সে। পায়ে পায়ে পেরিয়ে যেতে চায় সব বাধা, পায়ের নীচে মাড়িয়ে দিয়ে যেতে চায় সব
না-পাওয়াগুলো।
তবু এক সময় থামতে হয় তাকে, হাঁটুতে হাত রেখে সামনে ঝুঁকে হাঁপাতে থাকে সে, তার ফর্সা গাল পরিশ্রমের ভারে লাল হয়ে ওঠে। জিম ভেস্ট ভিজে লেপ্টে যায় শরীরে। এ যেন নিজের শরীরের ওপর জীবনের অপ্রাপ্তিদের প্রবল প্রতিশোধ।
ধীরে ধীরে জিমের ম্যাটে বসে পড়ল মঞ্জীরা। আর তখনই নিজের পাশে একটা ছোট কিশোরী দেহের অস্তিত্ব অনুভব করল সে। এই মেয়ে বাস্তবের কেউ নয়, সে কিশোরীবেলার মঞ্জীরা। স্প্রিন্টার মঞ্জীরা। তার পরনে প্রতিযোগিতায় নামার শর্টস
আর টি-শার্ট।
বহু বছর কেটে গেলেও এই কিশোরী পুরোপুরি মঞ্জীরাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। মঞ্জীরার হারানো শৈশব, তার ধুলোবালি মাখা স্প্রিন্টিং ট্র্যাকের দিনগুলো নিয়ে এই মেয়ে আজও হঠাৎ-হঠাৎ ফিরে আসে তার কাছে। কয়েক মুহূর্তের ফিরে আসা। দুটো কথা, মৃদু খুনসুটি, ব্যস ওই পর্যন্তই। আজও সেই কিশোরী হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল মঞ্জীরার পাশে।
“কী মঞ্জি! এইটুকুতেই হয়ে গেল? আর একটু টানলে পারতে।”
“অনেক হয়েছে। কী হবে এত ছুটে?”
“এখানেই তোমার সমস্যা। সে দিন রেসে পুরুলিয়ার মেয়েটাও পিছন থেকে এসে ওভারটেক করে বেরিয়ে গেল। তুমি এক বার শেষ চেষ্টাটুকুও করলে না!”
“আমি চেষ্টা করেছিলাম। শি ওয়াজ় টু গুড।”
“ছাই টু গুড। তুমি নিজেও জানো তুমি ওর থেকে বেটার স্প্রিন্টার। যে জোরটুকু দিলে মানুষ জিতে যায় সেই জেদটাই নেই তোমার।”
“আহ! আর কত দিন এই এক কথা নিয়ে...”
ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়েও থমকে গেল মঞ্জীরা। পাশের ট্রেডমিল থেকে থলথলে চেহারার এক জন পুরুষ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার
দিকে। হাওয়া বুঝে কখন যেন চম্পট দিয়েছে কিশোরী মঞ্জিও।
মঞ্জীরা তোয়ালে কাঁধে বেরিয়ে এল জিম থেকে।
তাদের বিল্ডিংয়ে ঢোকার মুখেই দেখা হল রঞ্জনাদির সঙ্গে। আলুথালু বেশ, নাইটির ওপর ওড়না চাপিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছে কোথাও।
মঞ্জীরাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল রঞ্জনা, “আরে মঞ্জীরা, কত দিন পরে দেখলাম তোমায়। ফিরতে আজকাল খুব রাত হয় বুঝি?”
আন্তরিকতার আড়ালে প্রচ্ছন্ন শ্লেষ। মঞ্জীরা জানে, গত সপ্তাহে তার ফিরতে বেশ ক’দিন একটু রাত হয়েছে। সে হয়তো রঞ্জনাদির বরেরও বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছে। তবে পুরুষের অফিস থেকে ফিরতে দেরি হওয়ার একটাই অর্থ, কাজের চাপ। মেয়েদের রাত হওয়ার হাজার একটা সম্ভাব্য কারণ আবিষ্কৃত হয়ে গেছে।
মঞ্জরী বলল, “একটা নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ হল গো, এই সময়টায় একটু চাপ যায়...” প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইল সে, “তুমি কোথায় ছুটলে?”
“এই দেখো না, সকালে উঠেই ছোট মেয়ে আবদার করেছে ব্রেড-ওমলেট না পেলে সে বিছানা ছাড়বে না। এ দিকে ফ্রিজে পাউরুটি নেই। যাই, নিয়ে আসি। এর নাম সংসার, বুঝলে?”
“আহা, ছেলেমানুষ, মায়ের কাছেই তো আবদার করবে!” লঘু স্বরে বলল মঞ্জীরা।
অন্যের ব্যাপারে আগ্রহ একটু বেশি থাকলেও আপদে-বিপদে রঞ্জনাদি ছুটে আসে, ডাম্বোটাকে একা রেখে বেরোতে হচ্ছে মাঝে মাঝে, কাজেই যতটা সদ্ভাব রাখা যায়।
মধ্য-তিরিশেই রঞ্জনার দেহে যৌবন বেশ বিপর্যস্ত, রীতিমতো পৃথুলা গিন্নিবান্নি হাবভাব তার স্থূল অবয়বে।
সামনে জিম ভেস্ট আর টাইট ট্র্যাক প্যান্টে এক আকর্ষণীয়া দাঁড়িয়ে থাকলে কোনও মেয়েরই স্বস্তি বোধ করার কথা নয়। বয়সে কতই বা ছোট হবে মঞ্জীরা তার থেকে?
রঞ্জনা চোখের কোণ দিয়ে মঞ্জীরার শরীরে হালকা চোখ বুলিয়ে নিচু গলায় বলল, “সে দিন তোমার বোনকে দেখলাম, ওই গড়িয়াহাটে একটা বুটিকে সেল চলছিল, ফেরার পথে ফ্লাইওভারের নীচে দেখি হনহন করে হাঁটছে মিহিকা আর পিছন-পিছন একটা ছেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। আমি তো প্রথমে ভয় পেয়ে গেছিলাম, তার পর দেখলাম, না, ভয়ের কী-ই বা আছে! ভরা বাজার চত্বর, দিনের বেলা, ভয়ের আর কী! আর তা ছাড়া এই তো বয়স... কী বলো?” ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসল রঞ্জনা।
প্রসঙ্গ অস্বস্তিকর, কী বলবে বুঝতে পারল না মঞ্জীরা। তাকে মুক্তি দিল রঞ্জনাদিই, হঠাৎ ব্যস্তসমস্ত হয়ে গোলগাল রঞ্জনা এগিয়ে যেতে লাগল, “না, চলি ভাই। তোমার দাদার আবার অফিস বেরোনোর সময় হয়ে যাবে। এই সময় আমার মনে হয় গ্যাসে পাঁচ-ছ’টা ওভেন থাকলে ভাল হত। বেঁচে গেছ ভাই, তোমায় এ সব ঝক্কি পোহাতে হয় না। না হলে তোমারও এই আমার মতো দশাই হত।”
শেষ বাক্যে আবার মৃদু ধাক্কা। দূরে যেতে যেতে রঞ্জনাদি বলে গেল, “তোমার ইয়ার-এন্ডের চাপ মিটলে এসো এক দিন, কত কাল যে দুটো গল্প করা হয় না, তোমরাও সব এত ব্যস্ত থাকো! কেমন যেন সব হয়ে যাচ্ছ তোমরা...”
ঈষৎ মাথা নাড়ল মঞ্জীরা। রঞ্জনাদির সঙ্গে বেশি ক্ষণ কথা বলা যায় না। ছোট থেকে ডাম্বোর দেখাশোনা অনেকটা এই ভদ্রমহিলা সামলে দিয়েছেন, এখনও প্রয়োজনে ডাকলে ছুটে এসে বুক দিয়ে সব করে দিয়ে যাবেন রঞ্জনাদি, জানে মঞ্জীরা।
তবু রঞ্জনাদির জিভে মোলায়েম একটা ছুরি আছে, মিছরির ছুরি। মিষ্টি হাসি দিয়ে সেই ছুরির জখমের ওপর লঙ্কাবাটা ঘষে দেয় রঞ্জনাদি।
ধীর পায়ে লিফটে উঠে ছ’তলার বোতাম টিপেছে মঞ্জীরা। মনটা তেতো হয়ে গেছে। রঞ্জনাদির শেষ কথাটা তাকে হুলের মতো বিঁধেছে।
রঞ্জনাদির যা আছে, তা কি মঞ্জীরারও হতে পারত না? এই ফ্ল্যাট থেকেই অফিস আর স্কুলে যাওয়ার জন্য এক সঙ্গে বেরোত আকাশদীপ আর ডাম্বো? সকাল থেকে তাদের পরিচর্যায় নিজের দিকে তাকানোর ফুরসত পেত না মঞ্জীরা।
আচ্ছা, আকাশদীপ থাকলে কি এই চাকরিটা করতে দিত মঞ্জীরাকে? যা মেজাজ ছিল বাবুর, হয়তো নিদান দিয়ে বসত, ‘ভুলে যাচ্ছ তুমি আকাশদীপ গাঙ্গুলির বৌ, আজ বাদে কাল যে লোক বিধানসভায় গিয়ে বসবে, তার বৌ করবে ওই পটেটো চিপস কোম্পানির সেলস ম্যানেজারের চাকরি!’
নিজেকে মৃদু ধমক দিল মঞ্জীরা। আর কত দিন? সে নিজেও জানে আকাশদীপ ফিরবে না তার কাছে।
স্বেচ্ছায় ডাম্বোর কাস্টডি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে রাজনীতি করে বেড়াচ্ছে আকাশদীপ। ডাম্বোর জন্য মাঝে মাঝে তার তরফ থেকে দামি গিফট এসে হাজির হয়, ডাম্বোর জন্মদিনে ফোন আসে একটা নিয়ম করে। এর বাইরে কি আকাশদীপ গাঙ্গুলির কোনও অস্তিত্বই আছে তার জীবনে? মঞ্জীরাকে কি সত্যিই আর আকাশদীপের বৌ বলা যেতে পারে?
তাদের সেপারেশনের তো প্রায় ছ’বছর হতে চলল।
মুখে ব্রাশ নিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মিহিকা, মঞ্জীরাকে ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখামাত্র সুড়ুত করে বাথরুমে ঢুকে গেল।
দেখেই গা জ্বলে গেল মঞ্জীরার। সকাল হতে না হতে প্রায় দিনই দুই বোনের মধ্যে এই সূক্ষ্ম লুকোচুরিটা চলে। দিদি ডাম্বোকে বাসে তুলে জিম-জগিং সেরে ফিরবে এ কথা মিহিকার অজানা নয়, তার পরেও যেন সে অপেক্ষায় থাকে, দিদি ফেরামাত্র বাথরুমের দখল চাই তার। পিঠোপিঠি বোন হলে নিশ্চিত চুলোচুলি লেগে যেত, কিন্তু দশ বছরের ছোট বোনের ওপর কতটাই বা রাগ করা যায়?
মঞ্জীরা গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকল। সকালে ডাম্বোর সঙ্গে সঙ্গে মিহিকার জন্যও ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছিল সে। গরম করল খাবারগুলো। মহারানি আবার সামান্য ঠান্ডা খাবারও মুখে তুলতে পারেন না। কফিও করল দু’কাপ। এটাও মিহিকার প্রেফারেন্স। সকাল সকাল বেশি চিনি দিয়ে এক কাপ কড়া কফি না হলে নাকি তার চোখ খুলতে চায় না, সারা দিন আলুনি ভাব থাকে শরীরে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে অবশ্য দেখা গেল মিহিকা দারুণ চটপটে, আজ অন্তত মর্নিং সিকনেস কাটাতে কফির দরকার পড়েনি। চটপট পরোটা ছিঁড়ছে, আলুভাজা জড়িয়ে মুখে তুলছে, দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে খবরের কাগজে।
মঞ্জীরা বলল, “এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? রয়েসয়ে খা। বিষম লাগবে।”
মিহিকা কাগজ থেকে চোখ সরাল না, “একটু তাড়া আছে।”
“কিসের তাড়া? আজ রেজ়াল্ট বেরোবে? অ্যানাউন্স করেছে কিছু?” মঞ্জীরা একটু উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইল।
“নাঃ, তা জানায়নি কিছু।”
“তা হলে? ক’টায় ক্লাস? এত আগে কলেজ গিয়ে কী করবি?”
মিহিকা মন দিয়ে কাগজ দেখছে, উত্তর দিচ্ছে না। তার মুখেচোখে সন্ন্যাসিনীর উদাসীনতা।
অভিরাজের এই এক নতুন যন্ত্রণা হয়েছে।
আজকাল মাঝে মাঝেই তার মনে হচ্ছে, জীবনটা আসলে কয়েকটা স্থিরচিত্রের যোগফল ছাড়া আর কিছু নয়।
একটা স্থিরচিত্র থেকে আর একটায় শুধু আজীবন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায় মানুষ। এক একটা ছবি যেন এক একটা স্টেশন, আর দুর্দান্ত গতির রেলগাড়ির মতো ছুটে চলেছি আমরা। অভিরাজের ধারণা, এই গতি একমুখী। প্রবল গতিতে অথবা ধীর লয়ে চলতেই পারো, কিন্তু এগিয়ে তোমায় যেতেই হবে, ফেরার পথ নেই।
এই মুহূর্তে বেসরকারি হাসপাতালের কেবিনে তন্দ্রাচ্ছন্ন অভিরাজের চেতনা জুড়ে একটার পর একটা স্থিরচিত্র যেন স্লাইড শো-র মতো সরে
সরে যাচ্ছে।
প্রথম স্থিরচিত্রে বাবার কোলে ছোট্ট অভিরাজ, পাশে হাসিমুখে মা। তার অন্নপ্রাশনের ছবি কি? কোণ ছিঁড়ে গেছে, সাদা-কালো সেই ছবিতে হলুদ ছোপ ফেলেছে সময়, তবু কত উজ্জ্বল! পরের ছবিতে সে দেখল স্কুলের পোশাক পরা অভিরাজকে, সাদা কালো ছবিতে রং বোঝা যায় না তবু মনে হচ্ছে নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট, সাদা শার্ট... সেই দিনটা তার স্কুলের প্রথম দিন।
পরের ছবিতে হালকা ইস্টম্যান কালারের ছোঁয়া। একঝাঁক ছেলেমেয়ে ডিমনা লেকের ধারে। ওই তো বাঁ দিকের শেষ লাইনে একদম ধার ঘেঁষে দাঁড়ানো লম্বা ছেলেটাই তো অভিরাজ, কে তুলেছিল ছবিটা? মনে পড়ার আগেই অভিরাজের ট্রেন এগিয়ে গেল পরের ছবির স্টেশনে।
সাদা শার্টের ওপর কালো বর্ডার দেওয়া সাদা সোয়েটার গায়ে অভিরাজ, ব্যাট হাতে মন দিয়ে শ্যাডো প্র্যাকটিস করছে, দু’চোখে ঘোর মগ্নতা। কখন তোলা ছবি? যে-বছর প্রথম সি এ বি আন্ডার নাইন্টিন টিমে ঢুকল, সেই বছরই কি? মনে করতে পারল না অভিরাজ।
আর একটা স্থিরচিত্র ভেসে উঠল চোখের সামনে। কারা যেন পাতলা ফিনফিনে কাপড় ধরে রেখেছে যুগলের মাথায়, আর সেই কাপড়ের নীচে সদ্যবিবাহিত অভিরাজ আর জুঁই, লজ্জা-জড়ানো চোখে প্রথমবার জুঁই দেখছে বরবেশী অভিরাজকে।
পরের ছবিটা সম্ভবত অভিরাজের জীবনের সেরা ছবি। বছর দশেক আগে বাংলা ক্রিকেট টিমের দলজিৎ সিং ট্রোফি জয়ের দিন। প্রকাণ্ড ট্রোফি হাতে সেই জয়ের অন্যতম প্রধান কারিগর অভিরাজ সেন।
ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল অভিরাজের। তত ক্ষণে পরের ছবিটা তার চোখের সামনে এসে গেছে খুব দ্রুত।
হাইওয়ের পাশে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। কোনও অ্যাক্সিডেন্টে সেই গাড়ির ডান দিকটা বেঁকেচুরে গেছে একেবারে, কাচ ভেঙে ছড়িয়ে আছে চারপাশে। অভিরাজ চুপিসাড়ে ছবিটার ভিতরে ঢুকে পড়ল। তার পর দুরুদুরু বুকে চালকের আসনে ছেতরে পড়ে থাকা রক্তাক্ত দেহটার মুখের দিকে তাকাল সে।
ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসল অভিরাজ।
নার্সিং হোমটাকে বেশ অভিজাত বলা যায়, পাশের কাউচে এই সময় জুঁইয়ের থাকার কথা। থাকার কথা, অথচ নেই। অভিরাজ চিন্তিত হল না। ভিজ়িটিং আওয়ার শুরু হতে চলেছে, জুঁই খুব সম্ভব বাইরের লাউঞ্জে আছে। সে চায় না সবার সঙ্গে দেখা করুক অভিরাজ, অনেক লোককে বাইরের লবি থেকেই বিদায় করে দেয় সে।
বিছানা থেকে নেমে অভিরাজ বুঝল আজ শরীর বেশ কিছুটা ঝরঝরে লাগছে তার। সে পায়ে পায়ে মস্ত বড় কাচের জানলাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ছ’তলায় তার কেবিনের প্রায় মুখোমুখি অতিকায় পাইথনের মতো একটা ফ্লাইওভার। বড় রাস্তার অন্য পারে একটা বিখ্যাত শপিং মলের সামনের সিঁড়িতে ইতিউতি জমে উঠছে ছেলেমেয়েদের ভিড়। বিকেল হওয়ার আগের সাদাটে মেরে যাওয়া সূর্য আলো ছড়াচ্ছে রীতিমতো। আজ কি খুব গরম? মার্চ-এপ্রিল মাসে বেশি গরম পড়লে সাধারণত বিকেলের দিকে কালবৈশাখী বলে একটা ব্যাপার হত তাদের ছোটবেলায়। এখনও কি সে রকম কিছুর অস্তিত্ব আছে? পিঙ্গল আকাশের দিকে তাকিয়ে
ভাবল অভিরাজ।
কাচের জানলার এপাশে এসির শাসন, বাইরের ধুলোবালির প্রবেশ নিষেধ।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। সে বুঝল পিঠের ব্যথাটা হালকা মালুম দিচ্ছে, হতাশায় দু’দিকে মাথা নাড়ল অভিরাজ। নাঃ! অ্যাক্সিডেন্টটা তার সর্বনাশ করে দিয়েছে। শরীর যা গেছে তা গেছেই, মূল সমস্যাটা হল প্রবল হেড ইনজুরির অভিঘাতে একেবারে ভেবলে গেছে সে।
চেনা মানুষকে চিনতে সময় লাগছে, চিনলেও নাম মনে আসছে না।
সবচেয়ে বড় কথা ইমোশনগুলো গুলিয়ে ঘেঁটে একশা হয়ে গেছে। হাসির কথা শুনলে চোখ ফেটে জল আসে, দুঃখের খবরে পেট গুলিয়ে হাসি পাচ্ছে। অভিরাজ বুঝছে ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু শুধরে নিতেই বা পারছে কোথায়!
কে জানে পুরোপুরি সেরে উঠতে আরও কত দিন লাগবে!
চিন্তাভাবনারই কি খেই আছে কোনও? এই মুহূর্তে মস্ত বড় ফ্লাইওভারটাকে দেখে মনে হচ্ছে হঠাৎ ভূমিকম্প হলে পিলার সমেত ওই প্রকাণ্ড পাইথন ধীরে ধীরে তার নার্সিং হোমের এই ছোট্ট কেবিনে সেঁধিয়ে যাবে।
শপিং মলের সিঁড়িতে দুটো ছেলেমেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। খোলা ভেঙে ছেলেটার মুখে বাদাম তুলে দিচ্ছে মেয়েটা, প্রতি বার ছেলেটি নিয়ম করে মেয়েটির আঙুল কামড়ে দিচ্ছে। বিরক্তিকর ব্যাপার। তবু বার বার মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠছে। যেন খাবার মুখে নিতে গিয়ে আঙুল কামড়ে দেওয়ার থেকে বড় কৌতুকের বিষয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
অভিরাজের মনে এলোমেলো চিন্তা আসছে। এই ছেলেমেয়ে দুটো কি সারাজীবন এক সঙ্গে থাকবে? নাকি কোনও তুচ্ছ কারণে আগামী কালই তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে? শুধু এই সিঁড়িতে বসে বাদাম খাওয়ার দৃশ্যটা একটা স্থিরচিত্র হয়ে থেকে যাবে দু’জনের জীবনে।
আসলে প্রেমের গল্পগুলো এমনই হয়। অবিরাম দু’টি স্থিরচিত্র পরস্পর মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে। এক জন বিখ্যাত মানুষ বলে গেছেন, গল্পটার থেমে যাওয়ার সময়ের ওপর নির্ভর করে সেটা মিলনের গল্প নাকি পুরোদস্তুর বিয়োগান্তক।
উটকো চিন্তাগুলো অভিরাজকে হয়তো আরও পাকে পাকে বেঁধে ফেলত, কিন্তু তখুনি তার কেবিনের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে তাকাল সে।
জুঁই ঘরে ঢুকল, জুঁইয়ের পিছু পিছু আর একটি মেয়ে। কালো লেগিংস এর ওপর ধূসর কুর্তি। মুখের জমিতে কাটাকুটি খেলছে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা।
মেয়েটি অভিরাজের দিকে চোখ তুলে চাইল, পোশাকের সঙ্গে মানানসই সেই মায়াকাড়া চোখের দৃষ্টিতে এক নিরালা বিষাদযাপন।
জুঁই স্বাভাবিক স্বরে অভিরাজকে বলল, “দেখো তো, চিনতে পারছ?”
অভিরাজ সহসা উত্তর দিল না, অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে, অস্ফুটে বিড়বিড় করছে কী সব।
এক সময় হঠাৎ আলো জ্বলেছে অভিরাজের চোখের তারায়, সে বলে উঠল, “মনে পড়েছে। এক বার মাঠে একটা ক্যাচ ধরেছিলাম। আর আপনি গ্যালারিতে লাফিয়ে উঠেছিলেন আনন্দে!”
জুঁই কাঁধে হাত রেখে অভিরাজকে থামিয়ে দিল।
অ্যাক্সিডেন্টটার পর আজ প্রায় তিন বছর কেটে গেছে। কিডনির কর্মক্ষমতা কমে গেছে অনেকটা, প্রেশার ফ্লাকচুয়েট করছে ঘন ঘন, মাঝে মাঝেই চোখে অন্ধকার দেখে দুমদাম পড়ে যাচ্ছিল অভিরাজ। ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান গম্ভীর মুখে হসপিটালাইজ়েশন সাজেস্ট করেছিলেন, একটা থরো চেক আপ আর মনিটরিং দরকার। তাই তাকে এই নার্সিংহোমে নিয়ে এসেছে জুঁই।
অ্যাক্সিডেন্টে গুরুতর আহত হয়েছিল অভিরাজ। তবে মাথাটা গোলমাল পাকাচ্ছে তার চেয়েও বেশি।
আর লোকের আনাগোনারও তো বিরাম নেই। ক্রিকেটমহলের হাজার লোকজন, তার ওপর রিটায়ারমেন্টের পর নিজের ক্রিকেট অ্যাকাডেমি খুলেছে অভিরাজ, সেখানকার ছেলেপুলে এসে হাজির হচ্ছে হুটহাট। ফেসবুকে অভিরাজ সেনের একটা ফ্যান ক্লাব আছে। হাজার বিশেক সদস্য। সেই গ্রুপের দুই অ্যাডমিনের উৎসাহ দেখার মতো, প্রায় মেডিক্যাল বুলেটিন দেওয়ার ঢংয়ে তারা অভিরাজের শরীরের খুঁটিনাটি আপলোড করছে তাদের পেজে।
এত দিন হয়ে গেল, সেরে উঠতে একটু বেশিই সময় নিচ্ছে অভিরাজ, মানুষটাকে কি একটু একা থাকতে দেওয়া যায় না?
জুঁই যথাসম্ভব আড়াল করছে স্বামীকে, সাইকায়াট্রিস্ট ডক্টর ঘোষ বলেছেন অভিরাজের এই মানসিক অবস্থায় তার আরও বিশ্রাম দরকার।
অপরিচিত, অর্ধপরিচিত লোকেদের তাই অভিরাজের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না জুঁই। কিন্তু এই মেয়েকে জুঁই ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। এই মেয়েকে অপরিচিত বলা যায় না, অর্ধপরিচিতও নয়। অবাক ব্যাপার হলেও সত্যি যে, এক বারও দেখা না হলেও এই মেয়ের সঙ্গে সম্ভবত জুঁই-অভিরাজের এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তাই এক কথায় জুঁই মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে অভিরাজের কেবিনে, কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয়নি, অভিরাজ মেয়েটিকে চিনতে পর্যন্ত পারছে না।
জুঁই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল, “কিছু মনে কোরো না। অ্যাক্সিডেন্টের ট্রমার পর থেকে ওর একটু...”
মেয়েটি জুঁইয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “আমি জানি, আমি ওঁর ব্যাপারে সব জানি। যা দেখছি, উনি তো এখন ভালই আছেন। কারণ ক্যাচ ধরার ঘটনাটা কিন্তু ভুল নয়।”
মেয়েটি এ বার অভিরাজের কাছে এসে দাঁড়াল, “আপনি জানেন, ও কোথায় আছে?”
প্রশ্নটা শুনে অভিরাজ সরাসরি মেয়েটির চোখে চোখ রাখল।
মেয়েটি আবার বলল, “আমি জানি, ওর খবর একমাত্র আপনার কাছে এলে পাওয়া যাবে। বলুন প্লিজ়, আমার খুব দরকার।”
জুঁই দেখল মিটিমিটি হাসছে অভিরাজ। মেয়েটি এবার কাতর কণ্ঠে প্রায় প্রার্থনার স্বরে বলল, “আমায় আজ তার কাছে পৌঁছতেই হবে দাদা, প্লিজ় বলুন, সে কি সত্যিই আছে এই শহরে, নাকি...”
মেয়েটি থেমে গিয়েছে। কেবিন জুড়ে অস্বস্তিকর থমথমে নীরবতা। অভিরাজ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। ছেলেমেয়ে দুটো চলে গেছে। সিঁড়ির সেই অংশটা যেন তাদের অভাবে ধু ধু করছে ফাঁকা।
অভিরাজ সেই অলস বিকেল গলায় ভরে বলল, “এইটাই সবচেয়ে মজার ব্যাপার। অবিরাম ভালবাসার মানুষের কাছে পৌঁছনোর পথ খুঁজে চলাটাই তো জীবন। তবে তার জন্য আগে ভালবাসার কাছে নিজেকে ছোট্টটি করে ফেলতে হবে। পুরোপুরি বিলিয়ে দিয়ে, নিজেকে নিঃস্ব করতে করতে একটা বিন্দুর মতো ক্ষুদ্র করে ফেলতে পারলেই কিস্তিমাত। দুটো বিন্দুকে যে সরলরেখা যোগ করে সেইটাই তো শর্টেস্ট রুট, নাকি!”
এবার মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়াল অভিরাজ। এই মুহূর্তে আর একটা স্থিরচিত্র দেখছে সে, চারতলা বাড়ির সমান উচ্চতা থেকে নেমে আসা ক্রিকেট বলটা সে তালুবন্দি করতেই গ্যালারিতে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে এই মেয়েটিই।
আর মেয়েটি স্পষ্ট দেখতে পেল ছ’ফুট দু ইঞ্চি উচ্চতার বেঙ্গল টিমের প্রাক্তন ফাস্ট বোলারের চোখের ওপর হালকা আর্দ্রতার ছোঁয়া।
একটু সামনে ঝুঁকে গাঢ় স্বরে অভিরাজ বলল, “সে জানত এক দিন তুমি আসবে। আমি জানি সে কোথায়। সবটা বলব তোমায়। তবে তার আগে তুমি আমায় বলো, এটা কি হালকা হাসির মিষ্টি প্রেম? নাকি চোখের জলের গ্রিক ট্র্যাজেডি? কোথায় শেষ হবে এই গল্পটা?”
২
বছরখানেক আগে স্কুলবাসটা আবাসনের গেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগেই ডাম্বো হাত তুলে জিনিসটা দেখাল মঞ্জীরাকে।
আবাসনে মোট পাঁচটা বিল্ডিং, প্রতিটি বিল্ডিংয়ে ছ’টা করে ফ্লোর। বিল্ডিংগুলো থেকে বেরিয়ে শান বাঁধানো আঁকিবুঁকি পথ চলে গেছে বিভিন্ন দিকে। সেই পথের ধারে ধারে যত্ন করে ফোটানো ফুল, লতা আর বাহারি গাছের সারি। একটা মাঝারি সাইজ়ের কদম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ডাম্বোর দিকে হাত নাড়ছিল মঞ্জীরা। তার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।
অথচ ডাম্বো যে প্রথম বার এমনটা করল তাও নয়, তার পরও মঞ্জীরা সতর্ক হয়নি। আজকাল মাঝে মাঝেই এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাচ্ছে ছেলেটা।
যে দিন ডাম্বোর মেজাজ-মর্জি ঠিকঠাক থাকবে, সে দিন সে ভোর থাকতে থাকতে নিজেই ঘুম থেকে উঠে বাথরুম সেরে নেবে। লক্ষ্মী ছেলের মতো চুকচুক করে খেয়ে নেবে হেল্থ ড্রিঙ্ক আর জ্যাম-ব্রেড। নিজে নিজেই ইউনিফর্ম পরে, চুল আঁচড়ে স্কুলের জন্য পুরোদস্তুর রেডি হয়ে নেবে সে।
কিন্তু এক একদিন ডাম্বো বেসুরে বাজতে শুরু করে। সেই দিনগুলোয় ডাম্বোকে বিছানা থেকে তুলতেই গলদঘর্ম হয়ে যায় মঞ্জীরা।
রীতিমতো টানা হ্যাঁচড়া করতে হয়, কয়েক বছর আগে তবু ঠিক ছিল, কিন্তু এখন ডাম্বো ক্লাস সিক্স, চেহারা বড়সড় হয়ে গেছে, তাকে টেনে তুলতে দম ধরে আসে মঞ্জীরার।
অনেক কাণ্ড করে যদি বা বাবুকে তোলা গেল, তখনও ব্রাশ দাঁতে নিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ডাম্বো, বেরোতে চাইবে না বাথরুম থেকে, অনিচ্ছুক বালককে এক রকম টানতে টানতে এই সব দিনে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে আসতে হয় মঞ্জীরাকে।
আজ তেমনই একটা দিন। মায়ের নাছোড় জেদের কাছে ডাম্বো এই দিনগুলোয় হেরে যায়, তার পরেও প্রত্যাঘাত করতে ছাড়ে না পরাজিত ডাম্বো।
কোনও দিন মায়ের চিরুনি, কোনও দিন হেয়ারক্লিপ, মোবাইল চার্জার... যেদিন যেটা পারে ব্যাগে করে নিয়ে হাঁটা দেয় ডাম্বো।
আজও ডাম্বো তেমনই একটা জিনিস নিয়ে স্কুল বাসে উঠেছে। মঞ্জীরা হাঁ হাঁ করে উঠল, ডাম্বোর অবশ্য তাতে বয়ে গেছে। সে বাসের জানলা দিয়ে জিভ ভেঙাল মাকে।
তিরিশ পেরিয়ে যাওয়া এক নারী স্কুলবাসের পিছনে ছুটছে, দৃশ্যটা মঞ্জীরার পছন্দ হল না। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল স্কুলবাস এগিয়ে যাচ্ছে বড় রাস্তার দিকে।